ওজু হল ইসলামের বিধান অনুসারে দেহের অঙ্গ-প্রতঙ্গ ধৌত করার মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জনের একটি পন্থা।যা সৌন্দর্য ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা লাভ করা যায়। নামাজের পূর্বে অযু করে নেয়া বাধ্যতামূলক। কুরআনে আছে, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারী এবং অপবিত্রতা থেকে যারা বেঁচে থাকে তাদেরকে পছন্দ করেন।” (সূরা বাকারা,আয়াত:২২২)।
কুরআন পড়তে ও স্পর্শ করতেও অযু করতে হয়। তবে তা বাধ্যতামূলক নয়। কুরআনে বর্ণিত আছে, “যারা পাক-পবিত্র, তারা ব্যতীত অন্য কেউ একে স্পর্শ করবে না।”(সূরা ওয়াক্কিয়াহ্, আয়াত:৭৯)। এখানে পাক পবিত্র বলতে দৈহিক পবিত্রতা নয় বরং আত্মিক পবিত্রতার কথা বলা হয়েছে। দেহ ও পরিধেয় কাপড়ের পবিত্রতা অর্জনকে আরবিতে বলে তাহারাত্। অযু বা গোসলের মাধ্যমে তাহারাত্ আর্জন করা যায়।হযরত মুহাম্মদ সাঃ বলেছেন, “পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ধর্মের অর্ধেক”। (সহীহ মোসলিম)।
শরীয়তের পরিভাষায় অজু বলতে আমরা বুঝি পবিত্রতা অর্জনের নিয়তে নির্দিষ্ট অঙ্গসমূহে পানি ব্যবহার করা
আমাদের আলোচনায় থাকবেঃ- সুন্নাত সমুহ,- ফরজ সমুহ,- ভঙ্গের কারন সমুহ,- মারকুহ সমুহ,- ফজিলত সমুহ ইত্যাদি।
ওযুর নিয়ত:-
উচ্চারনঃ নাওয়াইতু আন আতাওয়াজ্জায়া লিরাফয়িল হাদাসি ওয়া ইস্তিবাহাতা লিছছালাতি ওয়া তাকাররুবান ইলাল্লাহি তা’য়ালা।
অর্থ ঃ আমি ওযুর নিয়ত করছি যে নাপাকি দূর করার জন্য বিশুদ্ধরূপে নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্য এবং আল্লাহ তা’য়ালা।
অযুর দোয়া :-
بسم الله العلي العظيم والحمد لله علي دين الاسلام الاسلام حق والكفر باطل الاسلام نور والكفر ظلمة
বাংলা উচ্চারণঃ
(বিসমিল্লাহিল আলিয়্যিল আজিম। ওয়াল হামদুলিল্লাহি আলা দ্বীনিল ইসলাম। আল ইসলামু হাক্কুন। ওয়াল কুফরু বাতিলুন। ওয়াল ইসলামু নুরুন। ওয়াল কুফরু জুলমাত।)?
অর্থ :-
মহান ও পরাক্রান্ত আল্লাহ তায়ালার নামে আরম্ভ করছি। আমি দ্বীন ইসলামের উপর আছি। তাই আল্লাহর জন্য যাবতীয় প্রশংসা।নিশ্চই ইসলাম সত্য ও কুফুর বাতিল এবং ইসলাম আলো ও কুফুর অন্ধকার।
ওযুর চার ফরয :
১. সমস্ত মুখমন্ডল কপালের উপরিভাগের চুলের গোড়া হইতে থুতনী পর্যন্ত, এক কর্নের লতি থেকে অন্য কর্নের লতি পর্যন্ত ধৌত করা।
২.উভয় হাত কনুইসহ ধৌত করা।
৩.চারভাগের একভাগ মাথা মাসেহ করা ( ঘন দাঁড়ি থাকিলে আঙ্গুলী দ্বারা খেলাল করা ফরয )।
৪.উভয় পা টাখনু গিরা সহকারে ধৌত করা ।
ওযুর ১৪টি সুন্নাত
অজুর পদ্ধতি
১. অন্তরে অজুর নিয়ত করা।
২. বিসমিল্লাহ বলা।
৩. হাতের দু’কব্জি পর্যন্ত ধৌত করা (তিনবার)।
৪. মেসওয়াক করা: এর সময় হলো কুলি করার মুহূর্তে।
৫. কুলি করা, নাকে পানি দেয়া, নাক ঝাড়া (তিনবার)।
কুলি করা অর্থ : মুখের মধ্যে পানি প্রবেশ করিয়ে নাড়াচাড়া করা
. নাকে পানি দেয়া অর্থ: নিশ্বাসের সাথে নাকের মধ্যে পানি টেনে নেয়া।
৭. নাক ঝাড়া অর্থ: নাকের ভিতর থেকে পানি বের করা।
৮. মুখমন্ডল ধৌত করা (তিনবার) দাড়ি খেলাল করাসহ।
৯. আঙ্গুলের মাথা থেকে কনুই পর্যন্ত ডান হাত তিনবার ধৌত করা। অতঃপর একইরূপে বাম হাত ধৌত করা।
১০. মাথা মাসেহ করা: আর তার পদ্ধতি হলো প্রথমে হাত পানি দিয়ে ভিজিয়ে নেয়া। এরপর মাথার সামনের দিক থেকে পিছনের দিকে চুলের শেষ সীমানা পর্যন্ত হাত বুলানো। এরপর পেছনের দিক থেকে সামনের দিকে হাত ফিরিয়ে আনা (একবার)।
১১. তর্জনী অঙ্গুলি দিয়ে কানের ভিতরে মাসেহ করা আর বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে কানের বাহিরের অংশ মাসেহ করা (একবার)।
১২. ডান পা টাখনু পর্যন্ত ধৌত করা (তিনবার) অতঃপর একইরূপে বাম পা ধৌত করা ।
১৩. অজু শেষ করার পর এই দুআ পাঠ করা :
أَشْهَدُ أَن لَّا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّداً عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ اَللَّهُمَّ اجْعَلْنِيْ مِنَ التَّوَّابِيْنَ، وَاجْعَلْنِيْ مِن الْمُتَطَهِّرِيْنَ سُبْحَانَكَ اللهمَّ وَبِحَمْدِكَ، أَشْهَدُ أَن لَّا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ، أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوْبُ إِلَيْكَ.
(অর্থ) ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই। তিনি এক, তার কোনো শরীক নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল। হে আল্লাহ, আপনি আমাকে তাওবাকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন। আমাকে পবিত্রতা অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন। হে আল্লাহ, আপনার প্রশংসাসহ আপনার মহত্ব বর্ণনা করছি। সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি আর তাওবা করছি আপনার কাছে।’
(বর্ণনায় নাসায়ী)
এ কাজগুলো ওজুর ফরয হওয়ার পক্ষে দলিল হচ্ছে আল্লাহর বাণী:
“হে মুমিনগণ! যখন তোমরা সালাতের জন্য দাঁড়াতে চাও তখন তোমরা তোমাদের মুখমণ্ডল ও হাতগুলো কনুই পর্যন্ত ধুয়ে নাও এবং তোমাদের মাথায় মাসেহ কর এবং পায়ের টাখনু পর্যন্ত ধুয়ে নাও; এবং যদি তোমরা জুনুবী অবস্থায় থাক, তবে বিশেষভাবে পবিত্র হবে। আর যদি তোমরা অসুস্থ হও বা সফরে থাক বা তোমাদের কেউ পায়খানা থেকে আসে, বা তোমরা স্ত্রী সহবাস কর এবং পানি না পাও তবে পবিত্র মাটি দিয়ে তায়াম্মুম করবে: তা দ্বারা মুখমণ্ডল ও হাত মাসেহ করবে। আল্লাহ্ তোমাদের উপর কোন সংকীর্ণতা করতে চান না; বরং তিনি তোমাদেরকে পবিত্র করতে চান এবং তোমাদের প্রতি তাঁর নেয়ামত সম্পূর্ণ করতে চান, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর।”[সূরা মায়েদা, আয়াত: ৬]
খ. মুস্তাহাব পদ্ধতি: যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহতে বর্ণিত হয়েছে; ওযুর বিস্তারিত পদ্ধতি নিম্নরূপ:
১। ব্যক্তি নিজে পবিত্রতা অর্জন ও হাদাস (ওজু না থাকার অবস্থা) দূর করার নিয়ত করবে। তবে নিয়ত উচ্চারণ করবে না। কেননা নিয়তের স্থান হচ্ছে- অন্তর। সকল ইবাদতের ক্ষেত্রেই নিয়তের স্থান অন্তর।
২। বিসমিল্লাহ বলবে।
৩। হাতের কব্জিদ্বয় তিনবার ধৌত করবে।
৪। এরপর তিনবার গড়গড়া কুলি করবে (গড়গড়া কুলি: মুখের ভেতরে পানি ঘুরানো)। বাম হাত দিয়ে তিনবার নাকে পানি দিবে ও তিনবার নাক থেকে পানি ঝেড়ে ফেলে দিবে। ‘ইস্তিনশাক’ শব্দের অর্থ- নাকের অভ্যন্তরে পানি প্রবেশ করানো। আর ‘ইস্তিনসার’ শব্দের অর্থ- নাক থেকে পানি বের করে ফেলা।
৫। মুখমণ্ডল তিনবার ধৌত করবে। মুখমণ্ডলের সীমানা হচ্ছে- দৈর্ঘ্যে মাথার স্বাভাবিক চুল গজাবার স্থান থেকে দুই চোয়ালের মিলনস্থল ও থুতনি পর্যন্ত। প্রস্থে ডান কান থেকে বাম কান পর্যন্ত। ব্যক্তি তার দাঁড়ি ধৌত করবে। যদি দাঁড়ি পাতলা হয় তাহলে দাঁড়ির ওপর ও অভ্যন্তর উভয়টা ধৌত করবে। আর যদি দাঁড়ি এত ঘন হয় যে চামড়া দেখা যায় না তাহলে দাঁড়ির ওপরের অংশ ধৌত করবে, আর দাঁড়ি খিলাল করবে।
৬। এরপর দুই হাত কনুই পর্যন্ত তিনবার ধৌত করবে। হাতের সীমানা হচ্ছে- হাতের নখসহ আঙ্গুলের ডগা থেকে বাহুর প্রথমাংশ পর্যন্ত। ওজু করার আগে হাতের মধ্যে আঠা, মাটি, রঙ বা এ জাতীয় এমন কিছু লেগে থাকলে যেগুলো চামড়াতে পানি পৌঁছাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে সেগুলো দূর করতে হবে।
৭। অতঃপর নতুন পানি দিয়ে মাথা ও কানদ্বয় একবার মাসেহ করবে; হাত ধোয়ার পর হাতের তালুতে লেগে থাকা অবশিষ্ট পানি দিয়ে নয়। মাসেহ করার পদ্ধতি হচ্ছে- পানিতে ভেজা হাতদ্বয় মাথার সামনে থেকে পেছনের দিকে নিবে; এরপর পুনরায় যেখান থেকে শুরু করেছে সেখানে ফিরিয়ে আনবে। এরপর দুই হাতের তর্জনী আঙ্গুল কানের ছিদ্রতে প্রবেশ করাবে এবং বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে কানের পিঠদ্বয় মাসেহ করবে। আর মহিলার মাথার চুল ছেড়ে দেয়া থাকুক কিংবা বাঁধা থাকুক; মাথার সামনের অংশ থেকে ঘাড়ের ওপর যেখানে চুল গজায় সেখান পর্যন্ত মাসেহ করবে। মাথার লম্বা চুল যদি পিঠের ওপর পড়ে থাকে সে চুল মাসেহ করতে হবে না।
৮। এরপর দুই পায়ের কা’ব বা টাকনু পর্যন্ত ধৌত করবে। কা’ব বলা হয় পায়ের গোছার নিম্নাংশের উঁচু হয়ে থাকা হাড্ডিদ্বয়কে। দলিল হচ্ছে ইতিপূর্বে উল্লেখিত উসমান (রাঃ) এর ক্রীতদাস হুমরান এর বর্ণনা যে, একবার উসমান বিন আফফান (রাঃ) ওযুর পানি চাইলেন। এরপর তিনি ওযু করতে আরম্ভ করলেন। (বর্ণনাকারী বলেন), উসমান (রাঃ) হাতের কব্জিদ্বয় তিনবার ধুইলেন, এরপর কুলি করলেন এবং নাক ঝাড়লেন। এরপর তিনবার তার মুখমণ্ডল ধুইলেন এবং ডান হাত কনুই পর্যন্ত তিনবার ধুইলেন। অতঃপর বাম হাত অনুরূপভাবে ধুইলেন। অতঃপর তিনি মাথা মাসেহ করলেন। এরপর তার ডান পা টাখনু পর্যন্ত তিনবার ধুইলেন। অতঃপর অনুরূপভাবে বাম পা ধুইলেন। তারপর বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আমার এ ওযুর করার ন্যায় ওযু করতে দেখেছি এবং ওযু শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার এ ওযুর ন্যায় ওযু করবে এবং একান্ত মনোযোগের সাথে দু’ রাকাআত সালাত আদায় করবে, সে ব্যক্তির পিছনের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।”[সহিহ মুসলিম, ত্বহারাত ৩৩১]
ওযুর মাকরূহ সমুহ
১. অযুর সুন্নত সমুহের যে কোন সুন্নত ইচ্ছাকৃতভাবে ছেড়ে দিলে অযু মাকরূহ হবে।
২. প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি ব্যয় করা।
৩. মুখমন্ডল ধৌত করার সময় সজোরে মুখে পানি নিক্ষেপ করা।
৪. বিনা ওজরে বাম হাত দ্বারা কুলি করা ও নাকে পানি দেওয়ার এবং ডান হাতে নাক পরিস্কার করা।
৫. অপবিত্র স্থানে অযু করা।
৬,. মসজিদের মধ্যে অযু করা,তবে কোন পাত্রের মধ্যে অযু করা জায়েয।
৭. কফ্কাশী বা নাকের ময়লা অযুর পানির মধ্যে নিক্ষেপ করা।
৮. বিনা কারনে অন্যের সাহায্য নেওয়া।
অযুর প্রকারবেদঃ-অযু পাঁচ প্রকার ফরজ,ওয়াজিব,সুন্নত,মাকরূহ ও হারাম ওযু।
১. সকল প্রকার নামায পড়া ও কোরআন শরীফ তেলয়াতের জন্য এবং সেজদার তেলয়াতের জন্য অজু করা ফরজ।
২. কাবা শরীফ তওয়াফ করার জন্য ওয়াজিব।
৩. মোস্তাহাব বা সুন্নত ওযু হলো যা শরীর পাক রাখার জন্য করা হয় অর্থাৎ সব সময় ওজু রাখা সুন্নত।
৪. অযু করে কোন ইবাদত না করে সেই অযু থাকা অবস্থায় নতুন অযু করা মাকরূহ।
৫. হারাম অযু হলো কারো মালিকাধীন পানি জোরপুর্বক নিয়ে কিংবা ইয়াতীমের সংরক্ষিত পানি দিয়ে অযু করা হারাম।
ওযু ভঙ্গের কারণ সমূহ :
১. পায়খানা প্রস্রাবের রাস্তা দিয়া কোন কিছু বের হওয়া
২. মুখ ভরে বমি হওয়া
৩. শরীরের কোন জায়গা হতে রক্ত, পুঁজ বা পানি বের হয়ে গড়িয়ে পড়া
৪. থুথুর সাথে রক্তের ভাগ সমান বা বেশি হওয়া
৫. চিৎ বা কাত হয়ে হেলান দিয়ে ঘুম যাওয়া
৬. পাগল, মাতাল, অচেতন হওয়া এবং
৭. নামাযে উচ্চস্বরে হাসা।
ক) তিন কারণে অজু ফরজ হয়ে থাকে
১- নামাজ
আল্লাহ তাআলা বলেন,
(يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِذَا قُمۡتُمۡ إِلَى ٱلصَّلَوٰةِ فَٱغۡسِلُواْ وُجُوهَكُمۡ وَأَيۡدِيَكُمۡ إِلَى ٱلۡمَرَافِقِ وَٱمۡسَحُواْ بِرُءُوسِكُمۡ وَأَرۡجُلَكُمۡ إِلَى ٱلۡكَعۡبَيۡنِۚ )
{হে মুমিনগণ, যখন তোমরা সালাতে দন্ডায়মান হতে চাও, তখন তোমাদের মুখ ও কনুই পর্যন্ত হাত ধৌত কর, মাথা মাসেহ কর এবং টাখনু পর্যন্ত পা (ধৌত কর)।}[সূরা আল-মায়েদা : ৬]
২- কাবাঘরের তাওয়াফ
কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঋতুবতী মহিলাকে বলেছেন,
‘তুমি পবিত্র হওয়ার আগে তাওয়াফ করবে না।’(বর্ণনায় বুখারী)
৩- আল-কুরআন স্পর্শ করা
কারণ আল্লাহ তাআলা বলেছেন, (لَّا يَمَسُّهُۥٓ إِلَّا ٱلۡمُطَهَّرُونَ ) {পবিত্রগণ ব্যতীত কেউ তা স্পর্শ করে না।} [[আল ওয়াকিয়া: ৭৯]]
ক) উল্লিখিত সময় ছাড়া অন্যসময়ে অজু করা মুস্তাহাব
এর দলিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস,‘ঈমানদার ব্যক্তিই কেবল অজুর হেফাজত করে।’
(বর্ণনায় আহমাদ) সে হিসেবে নিম্নবর্ণিত জায়গাসমূহে অজু করা তাগিদসহ মুস্তাহাব:
প্রত্যেক নামাজের সময় অজু নবায়ন করা। আল্লাহ তাআলার যিকির ও দুআর সময়, কুরআন তেলাওয়াতের সময়, নিদ্রা যাওয়ার পূর্বে, গোসল করার পূর্বে অজু করা গুরত্বপূর্ণভাবে মুস্তাহাব। মৃত ব্যক্তিকে বহন করার পর ও প্রতিবার অজু ভঙ্গের পর অজু করা মুস্তাহাব, যদিও তখন নামাজ আদায়ের ইচ্ছা না থাকে।
১- অজু আল্লাহর ভালোবাসার কারণ
অজুর ফজিলতসমূহ
আল্লাহ তাআলা বলেন,
(إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلتَّوَّٰبِينَ وَيُحِبُّ ٱلۡمُتَطَهِّرِينَ)
{নিশ্চয় আল্লাহ তাওবাকারীদের ভালবাসেন এবং ভালবাসেন অধিক পবিত্রতা অর্জনকারীদের।} [সূরা আল বাকারা : ২২২]
২- অজু উম্মতে মুহাম্মাদীর আলামত; যেহেতু তারা কেয়ামতের দিবসে উজ্জ্বল অঙ্গ নিয়ে উপস্থিত হবে
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন আমার উম্মত অজুর অঙ্গগুলো উজ্জ্বল ঝলমলে অবস্থা নিয়ে উপস্থিত হবে। কাজেই তোমাদের যে এগুলো দীর্ঘ করতে চায় সে যেন তা করে নেয়।’(বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম।)
৩- অজু গুনাহ ও পাপ মিটিয়ে দেয়।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে অজু করে এবং সুন্দরভাবে অজু করে তার শরীর থেকে পাপসমূহ বের হয়ে যায়। এমনকি নখের নীচ থেকেও বের হয়ে যায়।’
(বর্ণনায় মুসলিম। )
৪- মর্যাদা বেড়ে যাওয়া
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদের এমন বিষয় সম্পর্কে খবর দেব না যার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা গুনাহ মিটিয়ে দেন ও মর্যাদা বৃদ্ধি করেন? তারা বললেন, অবশ্যই বলবেন ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, ‘কষ্ট সত্ত্বেও অজু পূর্ণভাবে করা, মসজিদের দিকে বার বার পদচালনা করা, সালাতের পর সালাতের জন্য অপেক্ষা করা। এটা হলো রিবাত।’(বর্ণনায় মুসলিম।)
ওজু শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত হচ্ছে- ইসলাম গ্রহণ করা, আকলবান হওয়া, বুঝদার হওয়া ও নিয়ত করা। এসব শর্তের কারণে কোন কাফের ওযু করলে ওযু হবে না। পাগলের ওযু হবে না। বুঝদার হয়নি এমন শিশুর ওযু হবে না। নিয়ত করেনি এমন ব্যক্তির ওযু হবে না; উদাহরণতঃ কেউ যদি ঠাণ্ডা উপভোগ করার নিয়তে এ অঙ্গগুলো ধৌত করে। ওযু শুদ্ধ হওয়ার জন্য পানি পবিত্রকারী হতে হবে। নাপাক পানি দিয়ে ওযু শুদ্ধ হবে না। অনুরূপভাবে ওযু শুদ্ধ হওয়ার জন্য যেসব বস্তু চামড়াতে ও নখে পানি পৌঁছতে বাধা দেয় সেসব জিনিস দূর করতে হবে; যেমন- মহিলাদের নখের মধ্যে ব্যবহৃত নেইল পলিশ।
জমহুর আলেমের মতে, ওযুতে বিসমিল্লাহ পড়ার বিধান রয়েছে। তবে আলেমেরা মতানৈক্য করেছেন— বিসমিল্লাহ পড়া ওয়াজিব নাকি মুস্তাহাব? ওযুর শুরুতে কিংবা মাঝখানে যে ব্যক্তির স্মরণে থাকে তার উচিত বিসমিল্লাহ পড়া।
পুরুষ ও মহিলার ওযু করার পদ্ধতিতে কোন পার্থক্য নেই।
ওযু সমাপ্ত করার পর এই দোয়া বলা মুস্তাহাব: ‘আশহাদু আনলা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহ। ওয়া আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহ’। দলিল হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমাদের কেউ যখন ওযু করে এবং পরিপূর্ণভাবে পানি পৌঁছায় কিংবা (বলেছেন) পরিপূর্ণভাবে ওযু করে এরপর বলে: ‘আশহাদু আনলা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহ। ওয়া আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহ’ (অর্থ- আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই। তিনি এক। তাঁর কোন শরিক নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল) তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজায় খুলে দেয়া হয়। সে দরজা দিয়ে ইচ্ছা সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে”[সহিহ মুসলিম, ত্বহারাত ৩৪৫; সুনানে তিরমিযিতে আরেকটু অতিরিক্ত এসেছে যে, ‘আল্লাহুম্মাজ আলনি মিনাত্তাওয়্যাবীন ওয়াজ আলনি মিনাল মুত্বাতাহ্হিরীন’ (অর্থ- হে আল্লাহ! আমাকে আপনি তওবাকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন, আমাকে পবিত্রতা অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন)[সহিহুত তিরমিযি গ্রন্থে (৪৮) আলবানী হাদিসটিকে ‘সহিহ’ আখ্যায়িত করেছেন]
[ শাইখ আল-ফাওযান লিখিত ‘আল-মুলাখ্খাস আল-ফিকহী’ ১/৩৬]
আপনি লিখেছেন “আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন, আমাদের নবীর প্রতি দয়া করেন”: শরয়ি বিধান হচ্ছে- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামে ওপর দরুদ পড়া; ঠিক যেভাবে আমাদের রব্ব আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন: “নিশ্চয় আল্লাহ্ নবীর প্রশংসা করেন এবং তাঁর ফেরেশ্তাগণ নবীর জন্য দো’আ-ইসতেগফার করেন। হে ঈমানদারগণ! তোমরাও নবীর উপর সালাত (দরুদ) পাঠ কর এবং তাঁকে যথাযথভাবে সালাম জানাও।”[সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৫৬]
অনুমোদিত জলের ধরন
- ঝর্ণা, সাগর ও নদীর জল
- বরফ গলা জল
- বড় পুকুর বা ট্যাঙ্কের জল
- বৃষ্টির জল
- কূয়ার জল
- প্রবহমান জল
অননুমোদিত জলের ধরন
- অপরিচ্ছন্ন বা অপরিষ্কার জল
- গাছ বা ফল নিসৃতঃ জল
- কোন কিছু মিশানোর কারণে যে পানির বর্ণ, গন্ধ, স্বাদ এবং গারত্ব পরিবর্তিত হয়েছে
- অল্প পরিমাণ পানি: যাতে অপবিত্র জিনিস মিশে গেছে (যেমনঃ মূত্র, রক্ত, মল বা মদ)
- অযু বা গোসলের জন্য ব্যবহৃত পানি
- অপবিত্র (হারাম) প্রাণী, যেমনঃ শূকর, কুকুর ও আন্যান্য হিংস্র প্রানীর পানকৃত পানির আবশিষ্ট
সুন্নি ইসলাম
সুন্নি মুসলমানরা নিম্নলিখিতগুলি কার্য সম্পাদন করেন:
- বিসমিল্লাহ্ বলে শুরু করা।
- দুই হাতের কব্জি পর্যন্ত ধোয়া।
- কুলি করা।
- পানি দিয়ে নাকের ভিতর পরিষ্কার করা।
- সমস্ত মাথা মসেহ্ এবং কানের সংলগ্ন স্থান মসেহ্ করা।
- হাত ও পায়ের আংগুলের মধ্যে ফাকা স্থান হাতের আংগুল দিয়ে ধোয়া।
- দাঁত পরিষ্কার করা। (মেস্ওয়াক করা উত্তম)
- অযুর কাজগুলো তিনবার করে করা।
কুরআনে বর্নিত আছে, “হে মুমিনগণ, যখন তোমরা নামাযের জন্যে উঠ, তখন স্বীয় মুখমন্ডল ও হস্তসমূহ কনুই পর্যন্ত ধৌত কর, মাথা মুছেহ কর এবং পদযুগল গিটসহ। যদি তোমরা অপবিত্র হও তবে সারা দেহ পবিত্র করে নাও এবং যদি তোমরা রুগ্ন হও, অথবা প্রবাসে থাক অথবা তোমাদের কেউ প্রসাব-পায়খানা সেরে আসে অথবা তোমরা স্ত্রীদের সাথে সহবাস কর, অতঃপর পানি না পাও তবে তোমরা পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করে নাও-অর্থাৎ, স্বীয় মুখ-মন্ডল ও হস্তদ্বয় মাটি দ্বারা মুছে ফেল। আল্লাহ তোমাদেরকে অসুবিধায় ফেলতে চান না; কিন্তু তোমাদেরকে পবিত্র রাখতে চান এবং তোমাদের প্রতি স্বীয় নেয়ামত পূর্ণ করতে চান-যাতে তোমরা কৃতজ্ঞাতা প্রকাশ কর।”(সূরা মায়িদা, আয়াত:৬)। অযুর করার সময় কিছু কাজ মুহাম্মাদ অভ্যাসবশত করতেন যা অযুর সুন্নতের (ঐচ্ছিক কাজ) অন্তর্ভুক্ত।