রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের ভাগ্য বিপর্যয়ের করুণ কাহিনী অনেক লম্বা। তবে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাশূন্য করার প্রত্যক্ষ অভিযানে নামে ১৯৭৮ সাল থেকে। ওই বছর অপারেশন ড্রাগন, এই সাংকেতিক নামের সামরিক অভিযান চালায়। তাতে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয় এবং সামরিক অভিযানের সময় আহত-নিহত হয় অনেক নিরীহ রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষ, যার সঠিক হিসাব কেউ পায়নি। এই সময় থেকে মিয়ানমারের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ সমস্যা বাংলাদেশের কাঁধে এসে পড়ে। তারপর আর থামেনি। ১৯৯১, ২০১২, ২০১৬ এবং এখন ২০১৭-তে এসে গত প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গা নির্যাতন ও নিধনের মাত্রা যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তার ভয়াবহতা বোঝাতে যথার্থ ভাষা ও শব্দ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ভয়ঙ্কর, ভয়াবহ, গণহত্যা, ধর্ষণ, জাতিগত নিধন, মানবিক বিপর্যয়, সভ্যতার লজ্জা, এসব অভিধা একসঙ্গে ব্যবহার করলেও বোধহয় পূর্ণাঙ্গ চিত্র ফুটে ওঠবে না। ১৯৭৮ সাল থেকে গত ২৫ আগস্ট, নতুন অভিযান শুরুর আগ পর্যন্ত প্রায় ৪০ বছর ধরে কম বেশি পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে অবস্থান করছে, যার ভার এখন বাংলাদেশের জন্য সীমাহীন অসহনীয় হয়ে উঠছে এবং একই সঙ্গে বহুমাত্রিক সামাজিক, রাজনৈতিক, সর্বোপরি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য ক্রমাগত জটিল হুমকি সৃষ্টি করছে। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আগামীতে সেটি কত বড় ভূখণ্ডগত ও জাতিগত নিরাপত্তার হুমকি সৃষ্টি করতে পারে তা ভাবনায় এলে শঙ্কিত হতে হয়।
এত বড় একটা আন্তর্জাতিক সমস্যার বোঝা এতকাল বাংলাদেশ প্রায় একাই বহন করে আসছে। অথচ এদের সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানের জন্য বা এর স্থায়ী সমাধান বের করার লক্ষ্যে বিশ্ব সংস্থাগুলো এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সেভাবে এ পর্যন্ত এগিয়ে আসেনি। শুধু প্রতিবেশী রাষ্ট্র হওয়ার জন্য এত বড় একটা আন্তর্জাতিক দায় বাংলাদেশের একার ওপর চাপিয়ে দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিশ্চুপ থাকা শুধু অন্যায্য নয়, তা অন্যায় এবং আন্তর্জাতিক রীতিনীতির লঙ্ঘন, যা বিশ্বের অন্য কোনো সমস্যার বেলায় হয়নি। তবে গত ২৫ আগস্ট যে প্রেক্ষাপট এবং যেভাবে নতুন করে সংকটটি জ্বলে উঠেছে তা সত্যই বড় উদ্বেগের বিষয়। মনে হচ্ছে শুধু মিয়ানমারের ভিতর থেকে নয়, বাইরের কোনো কোনো রাষ্ট্রও চাচ্ছে সংকটটি জ্বলন্ত থাকুক, যা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের ভীষণভাবে ভাবিয়ে তুলেছে।
জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান কমিশন কর্তৃক উজ্জ্বল সম্ভাবনাময়, ইতিবাচক ভারসাম্যমূলক ও সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য একটা প্রতিবেদন প্রণয়নের মাত্র ১২ ঘণ্টার মাথায় যা শুরু হলো সেটি ছিল একেবারে অপ্রত্যাশিত এবং অভাবনীয়। যৌক্তিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে কথা বললে সবাইকে স্বীকার করতে হবে সমাধানের পথকে ভুণ্ডুল করার জন্যই আঘাত-পাল্টা আঘাত হয়েছে এবং এটা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে তারাই করেছে যাদের ভূ-রাজনৈতিক বা গোষ্ঠীগত স্বার্থ বহাল থাকবে যদি রোহিঙ্গা সংকটটিকে জিইয়ে রাখা যায়।
আমরা সবাই জানি যৌথ অভিযানের প্রস্তাব প্রদান ও তার পরিচালনার কৌশল নির্ধারণের মধ্যে পার্থক্য অনেক। গত ৪০ বছর ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন, বিতাড়ন চললেও এবার সেটি আগের সব বর্বরতার রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে সামরিক অভিযান চলছে। সম্পূর্ণ এলাকা সিল করে দিয়েছে সেনাবাহিনী। মানবাধিকার সংস্থা, আন্তর্জাতিক সাহায্য ও ত্রাণ সংস্থা, সাংবাদিক, কেউ সেখানে প্রবেশ করতে পারছে না। কত বড় নিধনযজ্ঞ ও গণহত্যা সেখানে চলছে তা অনুমান করাও কঠিন হয়ে পড়ছে। জাতিসংঘ বলছে, গত তিন সপ্তাহে এক হাজারেরও বেশি নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছে। কোনো কোনো সূত্র বলছে নিহতের সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার চিত্র ধরা পড়েছে স্যাটেলাইটে। এ যাত্রায় নতুন করে তিন লাখেরও ঊর্ধ্বে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, যাদের আর্তচিৎকার ও অসহায়ত্ব আমাদের মতো ক্ষমতাহীন মানুষকে বিচলিত করলেও বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো একটু আধটু উহ-আহা করেই আবার নিশ্চুপ হয়ে যাচ্ছে। অথচ বিগত সময়ে বিশ্বের অন্য প্রান্তে ও অঞ্চলে এর চেয়ে কম মাত্রার মানবিক বিপর্যয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের যত বড় শক্তিশালী ভূমিকা দেখেছি তার কিছুই এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে না।