৯ম শতাব্দী
যেখানে সেবা সেখানে ইসলাম। এটা পুরাতন ইসলামের ঐতিহ্য। চিকিৎসা শাস্ত্রে মুসলিম মনীষীদের অবদান ৯ম শতাব্দীতে মুসলিম মনীষীগণই সভ্যতার প্রকৃত পতাকা বাহক। বিদেশী গ্রন্থাদির ভাবধারার সাথে আপন চিন্তাধারার সমাবেশ করে তারা এক নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন। খলিফা মামুন অনুবাদ কার্যের জন্য একটি স্বতন্ত্র বিভাগ খুলেছিলেন। তিনি বাগদাদে যে বায়তুল হিকমা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাতে একটি অনুবাদ বিভাগও ছিল। আর এই অনুবাদের জন্য খলিফা কোনো রকম বৈষম্য সৃষ্টি না করে বিভিন্ন জাতি হতে লোক নিযুক্ত করতেন।
এসব লোকের গবেষণার ফলে ব্যাকরণ, অলংকার শাস্ত্র, ভাষাতত্ত্ব, ভূগোল, ইতিহাস, রসায়ন শাস্ত্র, উদ্ভিদ বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান, জ্যোতি শাস্ত্র এককথায় জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রত্যেক শাখা প্রশাখার উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল।
৯ম শতাব্দী হতে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ছিল মুসলিম মনীষীদের চিকিৎসা বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনের জন্য স্বর্ণ যুগ। এ শতাব্দীতে চিকিৎসা বিজ্ঞানে সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল আবু আলী আল হুসাইন ইবনে সিনা। ইসলামের অন্যতম এই চিকিৎসা বিজ্ঞানী সমগ্র ইউরোপ জুরে তিনি এতটাই জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন যে, তাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক বলা হত। তিনি বুখারার নিকটবর্তী আফসানা নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানের উপর আল-কানুন ফিততিব নামক গ্রন্থ রচনা করে সু-পরিচিতি লাভ করেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানী ছাড়াও ইবনে সিনা ছিলেন দার্শনিক, গণিতজ্ঞ, ভাষাতত্ত্ববিদ, কবি ও সাহিত্যিক।
১২৫টি গ্রন্থ
ইবনে সিনা বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রায় ১২৫টি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তার কিতাব আল-সিফা দর্শনের উপর একটি শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। এটা ৮টি খণ্ডে বিভক্ত ছিল। মধ্যযুগের ইউরোপে এটা একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হত।
মুসলিম খলিফাদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রথম বিজ্ঞানের যে উন্নতি সাধিত হয় তা হলো চিকিৎসা শাস্ত্র। উমাইয়া খলিফাগণ চিকিৎসা শাস্ত্রকে উৎসাহিত করলেও মূলত আব্বাসীয় আমলে চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রকৃত উন্নতি হয়। এ যুগে অনেক অনুবাদক ও চিকিৎসক চিকিৎসা শাস্ত্রের উপর নতুনভাবে আলোকপাত করেন। এ ভাবে তারা তাদের মৌলিক চিন্তা-ধারার স্বার রেখে গেছেন।
খলিফা আল মনসুরের রাজত্বকালে গ্রিক বিজ্ঞানের অনুবাদ কার্য জুন্দিশাপুর কলেজে পূর্ণোদ্যমে আরম্ভ করা হয়। জুন্দিপুরের প্রধান চিকিৎসাবিদ ছিলেন বখত ইসু। তার পুত্র জুরদাসকে খলিফা আল মনসুর তার দরবারে আমন্ত্রণ জানান। ইতিহাসের কালক্রমে এ বখত ইসু-এর পরিবার বাগদাদে স্থায়ী ভাবে বসবাস করা শুরু করে এবং আড়াই শতাব্দী ধরে খলিফাদের চিকিৎসক হিসেবে কাজ করে। তার পর আস্তে আস্তে আরো চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি সাধিত হয়। যা এক সময় শুরুই করেছিলেন মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানীগণ।
ঔষধ প্রস্তুত প্রণালীর উন্নতি রোগ নিরাময়ে ঔষধ প্রয়োগ ব্যবস্থায় আরবগণ বিশেষ অগ্রগতি সাধন করেন। আর্তমানবতায় মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানীগণ সমগ্র পৃথিবীতে রোগ নির্ণয়ের জন্য হাসপাতাল নির্মাণ করেন। মূলত তারাই ঔষধ প্রস্তুত ও ঔষাধালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং ভেষজ বিজ্ঞান সংক্রান্ত গ্রন্থাদি প্রকাশ করেন। খলিফা আল মামুন ও মুতাসিমের আমলে চিকিৎসা বিজ্ঞানের মান উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন।
হুসাইন বিন ইসহাক
অনুবাদ কার্য আরম্ভ হলে চিকিৎসা শাস্ত্রের উপর অনেক গ্রিক ও অন্যান্য বিদেশী গ্রন্থ অনুদিত হয়। হুসাইন বিন ইসহাক নামক একজন আরবীয় খৃষ্টান হিপোক্রাটসের সাতখানা বই গ্যালেন ও পলের রচনাদি, ভিসকোরা ইউসের মেটারিয়া মেডিকো প্রভৃতি গ্রন্থাবলী অনুবাদ করেন। তার পুত্র ইহসাক ইসা বিন ইয়াহ ইয়া ও কুস্তইবনে লুকাত চিকিৎসা শাস্ত্রের গ্রন্থ অনুবাদ করেন। ৮২০ খৃষ্টাব্দ থেকে ৯০১ খৃস্টাব্দ যাবিত বিন কুবরা হাররানে স্বাধীন ভাবে কাজ করতেন এবং মাথা বুক প্রভৃতি রোগের উপর পুস্তক প্রকাশ করতেন বা করেন।
মুসলিম মনীষীগণ চিকিৎসা বিজ্ঞানের পাশাপাশি, শৈল চিকিৎসা, হাম বসন্ত রোগেরও চিকিৎসা করেছেন। অনুরূপ ভাবে চু চিকিৎসার েেত্রও মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেন। যা আজো পৃথিবীর বুকে ইতিহাস হয়ে আছে।
মৌলিক গবেষণায় ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের যে সকল নাম সমধিক প্রসিদ্ধ হয়েছে তাদের মধ্যে আত তাবারী, আল রাযী, আলী বিন আব্বাস ও ইবনে সিনা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। আলী আত তাবারী ছিলেন মুসলিম খলিফা মুতাওয়াক্কিলের গৃহ চিকিৎসক। তিনি খলিফার পৃষ্ঠপোষকতায় “ফেরদৌস উল হিকমা’ একখানা বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থে শুধু চিকিৎসা শাস্ত্রই নয়, দর্শন, জ্যোতি বিজ্ঞান ও প্রাণিবিদ্যা সম্বন্ধেও আলোচিত হয়েছে। এটা গ্রিক, ইরানী ও ভারতীয় শাস্ত্রের উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে।
মুসলিম চিকিৎসাবিদদের মধ্যে আবু বকর মুহাম্মদ বিন জাকারিয়া আল রাযী ছিলেন মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ একজন চিকিৎসাবিদ। তিনি গ্রিক, পারসিক ও ভারতীয় চিকিৎসা শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞ হুসাইন বিন ইসহাকের ছাত্র ছিলেন।
মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানী আল রাযী প্রায় দুই শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। আর এর অর্ধেকই ছিল চিকিৎসা শাস্ত্র সম্বন্ধীয় বসন্ত ও হাম সম্পর্কীয়। তার জগত বিখ্যাত গ্রন্থ আল-জুদারী আল হাসাবাহ প্রথমে ল্যাটিন ও পরে ইংরেজিসহ অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। চিকিৎসা শাস্ত্রের জন্য তার সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হলো “আল হাভী” এটা মোট বিশ খণ্ডে লিখিত।
মুসলিম মনীষী আল রাযী বাগদাদ হাসপাতালের (বিমারিস্থান) প্রধান চিকিৎসক ছিলেন। অস্ত্রোপাচারে তিনি সিটরের আবিষ্কার করেন। চিকিৎসা শাস্ত্র ছাড়াও তিনি ধর্মতত্ত্ব, অংকশাস্ত্র প্রভৃতি বিজ্ঞান ও জ্যোতি বিজ্ঞানের উপরও বহুগ্রন্থ লিখেছেন।
আলী বিন আব্বাস : আলী বিন আব্বাস পারস্যের জরোষ্ট্রীয় বংশোদ্ভূত মুসলমান ছিলেন। তিনি আল কিতাব আল মালিক নামে যে বিশ্বকোষ লিখেছেন তা ল্যাটিন জগতে Liber Regius নামে পরিচিত।
উক্ত গ্রন্থে ঔষধের সূত্র ও ব্যবহার সম্পর্কে আলোচিত হয়েছে। তখনকার বুয়াইশ শাসক আযদদ্দৌলার নামে এ গ্রন্থ উৎসর্গিত হয়েছিল যা ল্যাটিন ভাষায় মোট দুইবার অনূদিত হয়। আবু আলী হুসাইন বিন সিনা তার যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ ছিলেন। তিনি ইউরোপে আভিসিনা নামে পরিচিত। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উপর তার বিখ্যাত গ্রন্থ কানুনুল হিকমাহ আরব জগৎ হতে ইউরোপে আনিত সর্বাধিক প্রভাবশালী গ্রন্থ। একে চিকিৎসা শাস্ত্রের বাইবেল বলে।
১৫৯৩
ইবনে সিনার কানুন সম্পর্কে অধ্যাপক হিট্রি বলেন, কানুনের আরবি সংস্করণ ১৫৯৩ সালে রোমে প্রকাশিত হয়েছিল। এবং এটা একটি প্রারম্ভিক যুগের মুদ্রিত গ্রন্থ। আরবি চিকিৎসা বিজ্ঞানে তার স্থান অদ্বিতীয়। আবুল কাসেম (আল বুকাসিম) রচিত ‘আত তাসরিক’ ইউরোপে অস্ত্রোপাচার প্রবর্তনে বিশেষ ভাবে সাহায্য করেছিল।
ইবনে রুশদ আর একজন শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা বিজ্ঞানী ছিলেন। তিনি মুসলমানদের উদ্ভাবিত ঔষুধ প্রস্তুত বিদ্যায় বিশেষ দ ছিলেন। তিনি অনেক রোগের প্রতিশেধকও আবিস্কার করেন। এ ছাড়াও তিনি অনেক চিকিৎসা শাস্ত্রে অবদান রেখেছিলেন।
মুসলমান শাসকগণ চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য মুসলিম, অমুসলিম সকলকেই উদারভাবে সাহায্য সহযোগিতা করতেন। তারা স্থায়ী চিকিৎসা নিরাময়ের জন্য হাসপাতাল তৈরির পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ হাসপাতালেরও ব্যবস্থা করেছিলেন। অপর দিকে মুসলিম হাসপাতালে নারীদের জন্য স্বতন্ত্র ব্যবস্থাপনা ছিল।
রোগ নির্ণয় বিদ্যা মুসলিম শাসন আমলে উন্নতির চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। তেমনি ভাবে চু চিকিৎসা শাস্ত্র ও মুসলমানদের নিকট বিশেষভাবে ঋণী। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য বসরার আবু আলী হুসাইন আল হিশাম প্রথম সিদ্ধান্ত নেন যে আলোক রশ্মি বাইরের বস্তু হতে চুতে আসে, চু হতে বস্তুতে যায় না।
রসায়ন শাস্ত্রে মনীষীদের অবদান : চিকিৎসা শাস্ত্র, জ্যোতি শাস্ত্র, গণিত ও ভূগোল শাস্ত্রের পর মুসলমানদের শ্রেষ্ঠ অবদান হলো রসায়ন শাস্ত্র। আরবরা আধুনিক শাস্ত্রের আবিষ্কারক। রসায়ন শাস্ত্রকে আরবরা আল কিমিয়া বলত এবং তা হতেই মসূল আল কেমী কেমিস্ট্রি শব্দ উদ্ভব হয়েছে। যা বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞানে রসায়ন শাস্ত্র নামে পরিচিত।
খালিদ বিন ইয়াযিদ মাবিয়া হতে আল কেমী বা রসায়ন শাস্ত্রের আরম্ভ হয়। তিনি ছিলেন আরবদের মধ্যে প্রথম রসায়নবিদ। কিন্তু আব্বাসীয়দের আমলে মুসলমান বৈজ্ঞানিকগণ এ বিজ্ঞান শাস্ত্রের যথেষ্ট উন্নতি সাধন করেন। ‘মি. হামবোল্ট বলেন, আধুনিক রসায়ন শাস্ত্র মুসলমানদেরই আবিষ্কার বলা যায় এবং এ দিক দিয়ে তাদের কৃতিত্ব অদ্বিতীয়।
মুসলিম বিজ্ঞানীগণ প্রাচীন রসায়নের অসারতা প্রমাণ করেন। তারা পারস্য, সীসা, তাম্র, রৌপ্য ও স্বর্ণের রাসায়নিক স্বাদৃশ্যের সন্ধান করেন। তারা ধাতুর সাথে অম্লজান মিশ্রণ ও হিসাব নিরূপণের জন্য রাসায়নিক পদ্ধতি সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন, মুসলিম মনীষীগণই পৃথিবীকে সর্বপ্রথম পাতন পরিশ্রাবণ ও স্বচ্ছকরণের শিাদান করেন। তারা তরল পদার্থকে বাম্পে পরিণত করতে জানতেন।
জাবির ইবনে হাইয়ানকেই বলা হয় আধুনিক রসায়ন শাস্ত্রের জনক। যিনি পাশ্চাত্যে জাবের নামে সুপরিচিতি লাভ করেছেন। মধ্যযুগের রসায়ন শাস্ত্রে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ আসনের অধিকারী। তিনি প্রাচীন রসায়নবিদদের তুলনায় অধিক মননশীলতার পরিচয় দেন। জাবির ইবনে হাইয়ান রসায়ন শাস্ত্রে সূত্রও ব্যবহারের বিশেষ উন্নতি বিধান করেন।
চতুর্দশ শতাব্দীর পরে জাবির ইবনে হাইয়ানের রচনাবলী এশিয়া ও ইউরোপে রসায়ন শাস্ত্রের নির্ভরযোগ্য নিবন্ধ হিসেবে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে সম হয়। তিনি রসায়ন শাস্ত্রের উপর প্রায় ৫০০ গ্রন্থ রচনা করেন। আর ২২টিরও বেশি মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেন।
তার এ সকল গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো-
১. কিতাব আল রাহমা কৃপার পুস্তক
২. কিতাব আল তাজমী = খর্বকরণ
৩. কিতাব আল জিবাক
৪. কিতাব আল সারকী প্রতীচ্যের পারদ ইত্যাদি গ্রন্থাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া তিনি লুঘুকরণ, বাষ্পীয় কারণ, তরলী করণ, সপটি করণ ইত্যাদি সূত্র এই মহান মুসলিম মনীষীদের আবিষ্কারের ফল। তিনি বিভিন্ন সূত্রকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আলোচনা করে উন্নতি সাধন করেছিলেন।
Love these!
Stay with us.
আমি গর্বিত আমি “মুসলিম”